সুতার সাতকাহন

 সুতার সাতকাহন

সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ লজ্জা নিবারণের জন্য নিজেকে আবৃত করে রাখে।একসময় মানুষের শরীরে অনেক বড় লোম থাকলেও,সময়ের বিবর্তনে তা ঝড়ে যেতে থাকে।জেনেটিক স্কিন-কালারেশন গবেষণার উপর নির্ভর করে জানা যায় যে, প্রায় এক মিলিয়ন বছর পূর্বে মানুষ তার শরীরের অপ্রয়োজনীয় লোম হারাতে শুরু করে। সেই সময় থেকেই তারা পোশাক পরিধানের দিকে ঝুঁকতে থাকে।শুরুর দিকে বিভিন্ন লতা পাতার আচ্ছাদন কে পোশাক হিসেবে ব্যবহার শুরু করে।তারপর একসময় সভ্যতার উন্নয়নের সাথে সাথে শুরু হয় সুতার তৈরি পোশাকের ব্যবহার।আজকের লেখায় রইল সেই সুতারই নানা আখ্যান।

সুতার আবিষ্কারকালঃ

টেক্সটাইলের সুতা তৈরির জন্য তন্তু বা আঁশগুলোকে কাটা হয়,পরে কাপড় তৈরির জন্য বোনা হয়।এই প্রক্রিয়াটি পাথর যুগের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্যে প্রদর্শিত হয়েছিল।প্রাচীন সময় থেকে আজ আধুনিক সময় পর্যন্ত প্রতি নিয়ত টেক্সটাইলের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটেই চলেছে।

যদিও ঠিক কখন থেকে সুতার ব্যবহার শুরু হয়,তা সম্পর্কিত কোনো সঠিক তথ্য জানা যায় নি,তার পরেও বিজ্ঞানীরা মেক্সিকোর বিভিন্ন গুহা থেকে পাওয়া সুতার বোল ও তুলা কাপড়ের টুকরা পরীক্ষা করে জানতে পারেন,সেগুলো কমপক্ষে ৭০০০বছরের পুরোনো।এছাড়া,খ্রিস্টপূর্ব ৩,০০০ বছর পূর্বে পাকিস্তানের সিন্ধু নদী উপত্যকায়, তুলার চাষ করা হত এবং তা থেকে প্রাপ্ত সুতা ব্যবহার করে কাপড় বোনা হত। প্রায় একই সময়ে, মিশরের নীল উপত্যকার আদিবাসীরা সুতার পোশাক তৈরি শুরু করে। আরব ব্যবসায়ীরাই প্রথম সুতার কাপড় ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল।পরবর্তীতে, ১৪৯২ সালে কলম্বাস আমেরিকা আবিষ্কার করার পরে বাহামা দ্বীপপুঞ্জে তুলা গাছ জন্মাতে দেখা যায়।

১৫০০ সালের মধ্যেই সুতা বিশ্বজুড়ে পরিচিতি পায়।ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তুলার জিন আবিষ্কারের ফলেই আজ বিশ্ব বাজারে তুলার এত চাহিদা। এলি হুইটনি ১৭৯৩ সালে সুতির জিনের পেটেন্ট আবিষ্কার করেছিলেন বলে জানা যায়।কিন্তু পেটেন্ট অফিসের রেকর্ড থেকে বোঝা যায় যে হুইটনির পেটেন্ট আবিষ্কারের প্রায় দুই বছর আগে নোট হোমস নামে একজন মেশিনবিদ প্রথম সুতির জিন তৈরি করেছিলেন।

সুতার প্রকারভেদঃ

সুতার প্রকারভেদ শুনলে হঠাৎ মনে হতে পারে,কটন,উল বা পলিএস্টার এর কথা বলা হচ্ছে।তবে বাস্তবিক অর্থে বিষয়টি ভিন্ন।সুতার প্রকারভেদের মাধ্যমে সুতার গঠনগত দিক বোঝানো হয়।অর্থাৎ গঠন কৌশলের উপর ভিত্তি করেই,সুতার এই প্রকারভেদ করা হয়।

স্পান ইয়ার্ন(Spun Yarn):স্ট্যাপল ফাইবার কে মোচড় দিয়ে স্পান ইয়ার্ণ তৈরি হয়।এক্ষেত্রে ফাইবার গুলো একই ধরনের হতে পারে,আবার বিভিন্ন ফাইবারের মিশ্রনও হতে পারে।প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি ফাইবারকে ‘ব্লেন্ডিং’ করে এই ইয়ার্ন বা সুতা তৈরি করা যায়।যেমনঃকটন-পলিস্টার,উল-এক্রেলিক।এই সুতা অধিক দীর্ঘস্থায়ী হয়।

এই ধরনের সুতা শিশুদের পোশাক,মহিলাদের ব্লাউজ,জ্যাকেট,জিন্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।

ফিলামেন্ট ইয়ার্ন(Filament Yarn):

যেসব ফাইবারের অনির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য থাকে তাকে ফিলামেন্ট ফাইবার বলে।দুই না ততোধিক ফিলামেন্ট ফাইবারকে একত্র করে টুইস্ট এর মাধ্যমে ফিলামেন্ট ইয়ার্ন তৈরি হয়।প্রায় সব সিন্থেটিক সুতাই ফিলামেন্ট ফাইবার থেকে তৈরি। প্রাকৃতিক ফাইবারের মধ্যে শুধুমাত্র ‘সিল্ক’ এই শ্রেনীর অন্তর্ভুক্ত।স্পান সুতার সাথে ফিলামেন্ট সুতার বড় পার্থক্য হল,স্পান সুতা থেকে ফিলামেন্ট সুতা অধিক মসৃন ও নমনীয় হয়। ব্যবহারঃপোশাক,লাগেজ ইত্যাদি।

সুতা তৈরির প্রক্রিয়াঃ

টেক্সটাইল এর ভাষায় সুতা তৈরির প্রক্রিয়াকে স্পিনিং প্রসেস বা ইয়ার্ন ম্যানুফ্যাকচারিং বলা হয়।সুতা তৈরির জন্য স্পিনিং এর মধ্য দিয়ে যেতে হয়।সকল ফাইবার থেকে সাধারণত সুতা তৈরি করা যায় না।ফাইবারের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্য থাকতে হয়,যাকে ‘স্ট্যাপল ল্যান্থ’ বলে।স্ট্যাপল ল্যান্থ বিশিষ্ট ফাইবারই সুতা তৈরির আদর্শ ফাইবার।

মূলত ফাইবারকে টুইস্ট বা পাকানোর মাধ্যমে সুতা তৈরি করা হয়।তবে প্রাকৃতিক সকল ফাইবারের থেকে সুতা তৈরির পদ্ধতি এক নয়।যেমনঃলম্বা তন্তু বা ফাইবারের ক্ষেত্রে(যেমনঃপাট, লিনেন)তুলনামূলক কম মোচড় দিতে হয়।অপরদিকে খাটো তন্তু (কটন,উল) এর ক্ষেত্রে মোচড়ের প্রয়োজন বেশি হয়।সুতায় যত বেশি মোচড় দেয়া হবে,সুতা তত শক্ত হবে। কিন্তু কিছু সাধারণ প্রক্রিয়া সকল ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান।যেমন: ব্লো রুম,ব্লেন্ডিং ও মিক্সিং,কার্ডিং ও কম্বিং,স্পিনিং।এছাড়াও কৃত্রিম সকল তন্তু থেকে সুতা তৈরির পদ্ধতিতে তেমন ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয় না।

বাংলাদেশে সুতা উৎপাদনঃ

দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০টি ছোট বড় সুতা উৎপাদনের কারখানা রয়েছে,যার মধ্যে ৬টি প্রায় ৭২ শতাংশ সুতার যোগান দিচ্ছে।প্রায় এক দশক আগেও গার্মেন্টস কারখানাগুলো প্রয়োজনীয় কাপড়ের প্রায় সিংহভাগই বাইরে থেকে আমদানী করতে হতো।কিন্তু এখন,দেশীয় কারখানাতেই তৈরি হচ্ছে সুতা।

দেশের বিভিন্ন দোকানে শতভাগ কটনের কাপড় বলে অনেক পোশাক বিক্রি করা হলেও তাতে শতভাগ কটন থাকে না।মূলত প্রায় ১০শতাংশ বা তারও বেশি পলিএস্টার এর ব্লেন্ডিং থাকে।পাশাপাশি এইসব তুলাও বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।কারণ এদেশের শিমুল তুলা দিয়ে বালিশ বা তোশক তৈরি করা গেলেও, তা থেকে সুতা তৈরি সম্ভব হয় না।তুলার যেই শর্ট স্ট্যাপল ল্যান্থ থাকে(১২-৬৪মি.মি)তা শিমুল তুলায় অনুপস্থিত বিধায়,এই তুলার আঁশ(ফাইবার)সুতা উৎপাদনে কার্যকরী নয়। ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, দেশের ৪০৭টি সুতাকলে বছরে ৯৯ কোটি টন সুতা উৎপাদিত হত। এ জন্য ৫৫ লাখ বেল তুলা আমদানি করতে হত,যা ২০২১ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করার সুযোগ আছে দেশের উদ্যোক্তাদের। এটি হলে তুলা আমদানি বেড়ে ১১০ লাখ বেলে দাঁড়াবে।

লিখেছেনঃঅনন্যা চক্রবর্ত্তী

RedLive

Related post

Leave a Reply

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।